বাংলা
Perspective

"অর্ধ-আপস-মীমাংসার খোঁজকে একপাশে সরিয়ে রাখুন!"

সমাজতন্ত্র এবং যুদ্ধ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াই

বুধবার, সোশ্যালিস্ট ইকুয়ালিটি পার্টি গাজা গণহত্যার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে অন লাইনে একটি সরাসরি আলোচনার আয়োজন করে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ইজরায়েলের তাণ্ডবের ঐতিহাসিক শিকড় বিশ্লেষণ করা হয় এবং এটি বন্ধ করার জন্য একটি সমাজতান্ত্রিক কৌশল অগ্রসর করে।

অনুষ্ঠানে SEP এর জাতীয় সম্পাদক জোসেফ কিশোর উপস্থিত ছিলেন; ছিলেন জেরি হোয়াইট, যিনি ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েব সাইটের শ্রম সম্পাদক; এবং ডেভিড নর্থ, WSWS আন্তর্জাতিক সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান।

গত এক বছর ধরে, মার্কিন মিডিয়া গাজায় গণহত্যাকে ৭ই অক্টোবর, ২০২৩-এর আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে, যা 'খাঁটি অসত্যতার' একটি অবর্ণনীয় প্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যের উপর শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের পুরো ইতিহাস, ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার পরম্পরা , সত্যটা আসলে ১৯৬৭ সাল থেকে ইজরায়েল অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে আছে, এবং ১৯৯১ সাল থেকে এই অঞ্চল জুড়ে মার্কিন যুদ্ধগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

তবে, বুধবারের ঘটনা, এই সরল ও ঐতিহাসিক পদ্ধতির বিপরীত মেরু উপস্থাপন করেছে, গাজা গণহত্যাকে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার গভীরতর সঙ্কটের ফসল হিসাবে তৈরি করেছে, যা মানবতার মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সাথে জড়িত।

এটি করার মাধ্যমে, ঘটনাটি মার্কসবাদী রাজনৈতিক পদ্ধতি এবং ট্রটস্কিবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের শক্তি এবং জ্বলন্ত প্রাসঙ্গিকতা প্রদর্শন করে।

তার প্রাথমিক মন্তব্যে, কিশোর গাজা গণহত্যাকে পুঁজিবাদী সমাজের দ্বারা বৃহত্তরভাবে 'বর্বরতাকে স্বাভাবিকীকরণ' করার অংশ হিসাবে প্রণয়ন করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে সরকারীভাবে মৃতের সংখ্যা ৪১,০০০ এ দাঁড়িয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া বা অনাহার এবং রোগের কারণে নিহতদের বিবেচনা করে প্রকৃত সংখ্যা ২,০০,০০০ এর কাছাকাছি হতে পারে। তিনি গাজার শিক্ষাগত কাঠামো এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংসের বর্ণনা দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল নির্মূল করার জন্য 'স্কলাস্টিসাইড'(scholasticide) শব্দটি ব্যবহার করেন।

এটি একটি সমাজের অভিব্যক্তি যেটি ঐতিহাসিকভাবে পুঁজিবাদের মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে: । অপরাধী ব্যক্তিদের অভিব্যক্তি হিসাবে কী ঘটছে তা কেউ সত্যিই বুঝতে পারে না। সকল দায়ী ব্যক্তির কারাগারে থাকার কথা, কিন্তু তারা একটি সামাজিক শ্রেণী এবং একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রকাশ করে যা একটি ঐতিহাসিক মৃত অবস্থায় পৌঁছেছে এবং তাকে উৎখাত করতে হবে। এবং এটিই কেন্দ্রীয় ইস্যু যা গাজায় গণহত্যার এক বছরে উদ্ভূত হয়েছে।

বৈঠকের শুরুর দিকে, নর্থ তাঁর মন্তব্যে ব্যাখ্যা করেন, 'এই সমস্ত ঘটনাই ইতিহাসে নিহিত।'

Loading Tweet ...
Tweet not loading? See it directly on Twitter

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সে দেখেছিল যে সবকিছু পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সময় এসেছে যেমনটি [১৯১৭ সালে] অক্টোবর বিপ্লব [রাশিয়ায়] না হলে হত।]। ঔপনিবেশিকতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্ন আধিপত্য পুনরুদ্ধার করতে।

নর্থ যোগ করেন, 'আমরা এখন যেটির মুখোমুখি হচ্ছি তা হল একটি ঐতিহাসিক সংকট যা মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অকার্জকারিতার মধ্যে নিহিত, এবং এটির মূল গভীরে রয়েছে।'

তিনি বলতে থাকেন, “মার্কস একবার বলেছিলেন, ‘ শিকড়ে যেতে হলে জঙ্গী হতে হবে।’ এই সংকটের মূলে কী? আমরা কীভাবে বর্তমান নৃশংসতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারি যার মাধ্যমে আমাদের সেগুলি বুঝতে এবং এটির মোকাবেলায় উভয়ক্ষেত্রেই কার্যকর পদক্ষেপ গড়ে তুলতে দেয়?

নর্থ উল্লেখ করেন যে সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ গাজা গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু 'এখনও পর্যন্ত, প্রতিবাদগুলির ক্ষোভ নৈতিকতার প্রকাশের স্তরেই রয়ে গেছে এবং এর মূল কারণের মোকাবেলা করতে একটি সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রকাশ ঘটেনি। আমি যেটি বলতে চাইছি, তা হল, এটি বোঝার জন্য যে কী একে চালনা করছে।'

নর্থ মার্কসবাদীদের দ্বারা চিহ্নিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক দ্বন্দ্ব পর্যালোচনা করেন, বিশ্ব অর্থনীতি এবং জাতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা, এবং উৎপাদনের সামাজিক চরিত্র এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির আধিপত্যের মধ্যে।

কিভাবে এই দ্বন্দ্ব সমাধান করা যেতে পারে? ইতিহাস আমাদের দেখায় দুটি উপায়ের মধ্যে একটি রয়েছে। হয় সেগুলি সমাধান করা হয়েছে, যেমনটি আমরা দেখছি, যুদ্ধের মাধ্যমে, বিশ্বব্যাপী এবং অভ্যন্তরীণভাবে, স্বৈরাচারী, এমনকি ফ্যাসিস্টিক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে, অথবা সেগুলি আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর একটি বিদ্রোহের মাধ্যমে এবং মানবতার বিশ্ব ফেডারেশনের সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সীমানা ভেঙ্গে ফেলে সমাধান করা হয়েছে।

এখন এটাই আমাদের সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কোনটি প্রাধান্য পাবে? ধ্বংসের দিকে প্রবণতাগুলি কি প্রাধান্য পাবে, নাকি সামাজিক পুনর্জন্মের দিকের প্রবণতাগুলি প্রাধান্য পাবে? অর্থাৎ, শাসক শ্রেণী কি যুদ্ধ ও গণ মানসের-দমনের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য অর্জন করবে, নাকি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎখাতের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী যে ঐতিহাসিক সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে তার সমাধান করবে?

নর্থ উপসংহারে এসেছেন, 'আমাদের সময়ের সমস্যাগুলির উত্তর কোনও মধ্যপন্থী সংস্কারবাদী পথে’র মধ্যে নেই।'

পুরো সভা জুড়ে একটি কেন্দ্রীয় বিষয় গড়ে উঠেছিল তা ছিল বিদেশে যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং দেশে শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এর মধ্যেকার সম্পর্ক, যা একই পুঁজিবাদী সংকটের দুটি দিক।

জেরি হোয়াইট ডেট্রয়েটের গাড়ী প্রস্তুতকারী শ্রমিকদের মধ্যে গণহত্যার বিরোধিতার দিকে ইঙ্গিত করেন। “শ্রমিকদের মধ্যে গভীর বিদ্রোহ রয়েছে। ... আমি একজন ওয়ারেন ট্রাক [ডেট্রয়েটের বাইরের জিএম অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট] শ্রমিককে চিনি, যিনি দুপুরের খাবার সময় তার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'আপনারা কি মনে করেন, আপনাদের ট্যাক্স এর ডলার কোথায় যাচ্ছে? তারা প্যালেস্তিনিদের হত্যার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে যাচ্ছে।

হোয়াইট শাসক অভিজাতদের যুদ্ধনীতির কাছে শ্রমিক শ্রেণীকে অধীনস্থ করার চেষ্টায় ট্রেড ইউনিয়ন শাসনযন্ত্রের ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন যে শ্রমিকদের তাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম 'মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে, প্ল্যান্ট বন্ধ এবং ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে, একটি শালীন জীবনযাত্রার মান রক্ষা করার লড়াই, বোয়িং-এর মতো পেনশন পুনরুদ্ধার করার জন্য তাদের লড়াইয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করা, এটি বোঝার জন্য যে এটি নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েছে পুঁজিবাদ এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে, কারণ, সর্বোপরি, এগুলিই সেই কর্পোরেশন যারা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে।'

বক্তারা জোর দেন যে শ্রমিকশ্রেণীকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে, এক বা অন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়।

একজন শ্রোতার প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছে, যিনি জিজ্ঞাসা করেন, 'চীন এবং রাশিয়া কি লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক এবং ইরানকে উন্নত অস্ত্র দিয়ে সমর্থন করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করবে?' নর্থ এর উত্তরে বলেন,

বিশ্বযুদ্ধের জন্য আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। আমরা কাউকে সমর্থন করি না এবং আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের সমর্থক নই। এর উত্তর শাসনব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে জাতীয় প্রতিরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে নেই বরং তা রয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতির মধ্যে।

কিশোর বলেন, শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকার বিষয়বস্তুর বিকাশে, গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন হল: 'এমন কোন সামাজিক শক্তি আছে কি যা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে সক্ষম?'

এর উত্তর, তিনি বলেন, হ্যাঁ আছে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণী। “

এটির সেই শক্তি বস্তুনিষ্ঠভাবে রয়েছে, কিন্তু সেই শক্তিটি কেবল সংগঠন, শ্রমিক শ্রেণীকে একত্রিত করার লড়াই এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যেতে পারে। এটির বিকাশ শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে হতে হবে।”

বৈঠকের শেষের দিকে, নর্থ বলেন,

'একটি বা অন্য আকারে যে মৌলিক প্রশ্নটি উঠেআসে তা হল, আপনি কি কিছুটা সহজ পথ দিতে পারেন না? সহজ সমাধান কী কিছু নেই? ঠিক আছে, আমরা এর প্রতিক্রিয়ায় যে প্রশ্নটি উত্থাপন করব তা হল, আমরা যে সমস্যাগুলির মুখোমুখি তার প্রকৃত সমাধান পুঁজিবাদী সমাজের সর্বোচ্চ থেকে ব্যাপক জনগণের মধ্যে সেই বিশাল সম্পদের স্থানান্তর ছাড়া হতে পারে এমণ কথা কি আপনি ভাবতে পারেন?”

আপনি কি এমন পরিস্থিতির একটি ধারাবাহিকতা কল্পনা করতে পারেন যেখানে ধনী, অতি-ধনী, ক্ষতিকারকভাবে ধনী তাদের সম্পদ আহরণে কোন বিধিনিষেধ মেনে নেবে? শ্রেণীগুলি এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেয় না। এবং যে কোনও ক্ষেত্রে, এটি তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রশ্নও নয়। এটি একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন। পুঁজিবাদ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে।

উপসংহারে নর্থ বলেন,

'আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি যেখানে মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তনকে প্রভাবিত করা সম্ভব। এই কারণেই, প্রতিটি মহান সময়ের মতো, এটি দুটির মধ্যে কোন একটি-। হয় মানবজাতি অগ্রসর হয় নয়তো ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। যদি সামাজিক বিপ্লব অসম্ভব হয়, তাহলে তার মানে হল মানবজাতির টিকে থাকা অসম্ভব।'

তিনি শ্রোতাদের প্রতি আহ্বান জানান, 'অর্ধ-আপস-মীমাংসা, মিথ্যা সমাধান এবং সহজ পথের সন্ধানকে একপাশে সরিয়ে রাখুন যা কারও খুব বেশি প্রয়োজন হয় না।'

গাজা গণহত্যা পুরো প্রজন্মের জন্য একটি সংজ্ঞায়িত সামাজিক অভিজ্ঞতা। শ্রমিক এবং তরুণরা বাস্তব সময়ে, বিশ্বের পুঁজিবাদী 'গণতন্ত্র' দ্বারা বন্দী ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নির্মূলতা প্রত্যক্ষ করেছে। তারা যে ভয়ঙ্কর চিত্রগুলি দেখেছে তা সেই বিভ্রমগুলিকে ভেঙে দিতে শুরু করেছে যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল, এই বিশ্বাস সহ যে বিংশ শতকের ব্যাপক হত্যাকান্ড একটি বুদ্ধিভ্রংশ ছিল যার পুনরাবৃত্তি হবে না।

গাজায় গণহত্যার এক বছর পর, মানবতা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার একটি গুরুতর এবং ঐতিহাসিক-ভিত্তি বিশ্লেষণ এবং এই সংকটের প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে এক ব্যাকুলতা রয়েছে। এই ভয়ঙ্কর ঘটনা এবং ভয়ঙ্কর অপরাধ থেকে, ফোর্থ ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক কমিটি দ্বারা সংগঠিত মার্ক্সবাদী ঐতিহ্যের জন্য নতুন দর্শক উঠে আসবে।

Loading