বাংলা

শত শত বিক্ষোভকারী ছাত্রকে পুলিশ হত্যা করার পর বাংলাদেশ সরকার ধরপাকড় শুরু করেছে

সর্বশেষ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আট দিনে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর হাসিনা সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় হামলার সময় অন্তত ২০১ জন নিহত এবং ৪,৫০০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। বাংলাদেশের একটি উচ্চ আদালত 2018 সালে বাতিল করা সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির জন্য একটি বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পরে, সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণ-বিক্ষোভ ১লা জুলাই শুরু হয়।

একজন ছাত্র, পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আহত হলে একটি হাসপাতালে স্টেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ২০শে জুলাই, 2024-এ [AP Photo/Rajib Dhar]

এই বিভাজনমূলক ব্যবস্থার অধীনে সরকারি চাকরির ৩০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল “মুক্তিযোদ্ধাদের” আত্মীয়-স্বজনদের জন্য-যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন-১০ শতাংশ নারী এবং দেশের অনুন্নত অঞ্চলের জন্য, ৫ শতাংশ জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য। এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ। অবশিষ্ট পদগুলিতে বর্তমান মেধা পদ্ধতি অনুযায়ী নির্বাচন করা হবে।

পুলিশের সহায়তায় হাসিনার আওয়ামী লীগ-নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) গুণ্ডারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে হিংসার রূপ নেয়।

ছাত্ররা সারা দেশে তাদের প্রচার আন্দোলন জোরদার করলে, পুলিশ হিংস্রতা বাড়ায়, ছাত্রদের উপর কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং গুলি নিক্ষেপ করে, কয়েক ডজন নিহত এবং আরও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। ১৯শে জুলাই, হাসিনা কার্ফু জারির আদেশ দেন, 'দেখা মাত্র গুলি করার' নির্দেশ দিয়ে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেন এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেন।

দেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা কমিয়ে আনার আশায়, হাসিনা সরকার সোমবার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যাতে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন করে নতুনভাবে পাবলিক সেক্টরে নিয়োগের ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে হবে বলে ঘোষণা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের জন্য কোটা কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য মনোনীত গ্রুপের জন্য ২ শতাংশ করা হয়েছে।

যদিও সরকার এই সপ্তাহে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টার জন্য তার কার্ফু শিথিল করেছে, বুধবার থেকে ব্যাংক, সরকারী অফিস এবং গার্মেন্টস কারখানাগুলিকে কাজ শুরু করার অনুমতি দিলেও, ইন্টারনেট এখনও পুরোপুরি চালু করা হয়নি, তবে পুলিশি ধরপাকড় অব্যহত আছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটবদ্ধ থাকার মিথ্যা অভিযোগ করে ছাত্র আন্দোলন কর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন।

বুধবার এডিটরস গিল্ডের এক সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে হাসিনা গত সপ্তাহের হিংস্রতার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন। ডেইলি স্টারের মতে, তিনি বৈঠকে বলেছেন যে 'সাম্প্রতিক ধ্বংসলীলা দেশের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধিকে পঙ্গু করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।'

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী সাম্প্রদায়িক সংগঠন ডানপন্থী বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রদের প্রতিবাদ আন্দোলনের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জনসমর্থনকে পুঁজি করার আশায়, বিএনপি ১৮ই জুলাই এর আগে পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের 'সমর্থন' করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। ১৯৯০ এবং ২০০১ সালে দুইবার ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকারগুলি হাসিনার আওয়ামী লীগের প্রশাসনের মতোই তাদের শাসনকালে শ্রমিক ও দরিদ্রদের শত্রু ছিল।

গত সপ্তাহে, হাসিনা ঢাকার কিছু অংশ সফর করেন রামপুরার টেলিভিশন ভবন স্টুডিও এবং মিরপুর-10 মেট্রো রেল স্টেশন সহ অনান্য সম্পত্তি ধ্বংস পর্যবেক্ষণ করেন, যার জন্য তিনি বিক্ষোভকারীদের উপর দোষারোপ করেন। বাংলাদেশের জনগণকে, তিনি ঘোষণা করেছিলেন, 'তাদের [যারা জড়িত] চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।'

হাসিনার এই মন্তব্যের ব্যাপক নিন্দা করা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে একজন এক্স/টুইটার ব্যবহারকারীর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে যিনি বলেছেন: “আমরা [শত শত] ছাত্রকে হারিয়েছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মেট্রো রেলের জন্য ‘কান্নাকাটি’ করার সময় ছিল, যারা আর কখনও ফিরে আসবে না তাদের জন্য নয়।” অন্য একজন 'রেল ট্র্যাকের জন্য কুমিরের অশ্রু ফেলার জন্য' ও পুলিশের হাতে নিহতদের বিষয়ে তিনি নীরব থাকায় প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা করেছেন। অন্যরাও দেখছেন যে তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত কোন ছাত্রদের পরিবারের সাথেই দেখা করতে যাননি।

ইউকে-ভিত্তিক গার্ডিয়ানের সাংবাদিকরা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন পুলিশ বাহিনীকে একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে জনতার উপর টিয়ারগ্যাস ছুড়তে এবং সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হালকা মেশিনগান ব্যবহার করতে দেখেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিশ্চিত করেছে যে পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনী শটগান, অ্যাসল্ট রাইফেল এবং গ্রেনেড লঞ্চার ব্যবহার করেছে।

ঢাকা-ভিত্তিক নিউ এজ-এর ২৫শে জুলাইয়ের একটি সম্পাদকীয়তে 'আইন প্রয়োগকারী কর্মীদের নির্বিচারে গুলি চালানো' এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অসংখ্য মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অনেকেই 'এখনও সঙ্কটজনক অবস্থায়' যাদের মধ্যে তারাও আছে যারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্টুডেন্টস এই সপ্তাহে দুবার তাঁদের প্রতিবাদ থামিয়েছে, প্রথমে সোমবার এবং পরে বুধবার, তাঁরা মঙ্গলবার একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে, যাতে সরকারের কাছে আটটি দাবি করা হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা, কার্ফু প্রত্যাহার, ছাত্র আন্দোলনের সকল সমন্বয়কের নিরাপত্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল পুনরায় চালু করা এবং ক্যাম্পাস থেকে সমস্ত পুলিশ প্রত্যাহার। সংগঠনটি 'শিক্ষার্থীদের গণহত্যার জন্য' হাসিনার কাছ থেকে 'জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার' এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করার দাবি করেছে।

নিপীড়ন ও পুলিশি অভিযানের ভয়ে অনেকের আত্মগোপন সেই সাথে পুলিশের হাতে ছাত্র কর্মীদের অপহরণ ও নির্যাতনের খবর অব্যাহত রয়েছে। স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ২৩ জুলাই গার্ডিয়ানকে বলেন যে তাকে ২০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তা ধরে নিয়ে যায়। 'তারা আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যা আমি চিনতে পারিনি এবং তারপরে আমাকে একটি ঘরে রেখেছিল যেখানে তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে এবং পরে আমাকে প্রথমে মানসিকভাবে এবং তারপরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে,' তিনি বলেন।

আব্দুল হান্নান মাসুদ, আরেক প্রতিবাদ সমন্বয়কারী, মিডিয়াকে বলেছেন যে সংগঠনটি 'সারা দেশে আহত প্রায় ১৫,০০০ বিক্ষোভকারীর যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি স্বাস্থ্য বাহিনী গঠন করার পরিকল্পনা করছে।'

এই সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্কের দ্বারা সরকারি হামলার একটি 'স্বতন্ত্র তদন্ত' করার আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশের সম্প্রচার ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত কুরুচিপূর্ণভাবে আল জাজিরাকে বলেছেন যে সরকার 'উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করেছে।' '

আরাফাত ঘোষণা করেছেন যে 'চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসী' সহ 'তৃতীয় পক্ষের' কর্মীরা যারা ছাত্র বিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে তার জন্য সরকার একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করেছে যা নিশ্চিত করবে 'এই হতাহতের জন্য দায়ী প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা।'

এগুলো নির্ভেজাল মিথ্যা। হাসিনা সরকার ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সরকারী ক্ষেত্রে চাকরির কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের উত্তাল বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় জানায় পুলিশ এবং ছাত্রলীগের দ্বারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে। কোটা ব্যবস্থা বাতিল করতে বাধ্য করা হলেও এটি পরিকল্পিতভাবে ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালায় ও সাজা দেয়।

জুন ২০২০ একটি ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডারের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে: 'বিক্ষোভ বন্ধ হওয়ার অনেক দিন পরেও, অনেক ছাত্র আন্দোলন কর্মী, তাদের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যরা নজরদারি, ভয়ভীতি এবং হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন, যাতে কার্যকরভাবে ভবিষ্যৎকালে ভিন্নমতের কন্ঠরোধ করা যায়।' বেশ কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধৃত করে, এটি উল্লেখ করেছে: “বিক্ষোভ আন্দোলন শেষ হওয়ার পরে একজন বিশিষ্ট আন্দোলন কর্মীকে আটবার আক্রমণ করা হয়েছিল। আরেকজন প্রতিবাদী সংগঠককে নিয়মিতভাবে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ধাওয়া করেছে।”

সর্বশেষ ছাত্র বিক্ষোভের সময় হাসিনা সরকারের মূল সমর্র্থনকারী ছিল বিভিন্ন স্তালিনবাদী দল যারা বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর এক বা অন্য অংশের সাথে নিজেদের একত্রিত করে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সোশ্যালিষ্ট পার্টি এবং রেভুলেশনারি কমিউনিষ্ট লীগ, যাদেরকে তথাকথিত লেফট ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সের অধীনে সংগঠিত করা হয়েছে, তাঁরা সরকার এর নিন্দা করেছে সেই সাথে ছাত্রদের বলেছে যে হাসিনা সরকারকে উপর চাপ দেওয়া সম্ভব।

আরেকটি স্তালিনবাদী গঠন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি হাসিনা সরকারের জোটের অংশীদার। ছাত্রদের উপর খুনি পুলিশ এবং সামরিক হামলায় ব্যাপক ক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে, এটি সরকারী নৃশংসতা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার মরিয়া চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ছাত্রদের 'উদ্বেগের সমাধান' করার জন্য সরকারের প্রতি বিনীতভাবে আহ্বান জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তার যুব শাখাকে সম্বোধন করেছেন।

বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হওয়া সামাজিক সমস্যাগুলি-দারিদ্র্য, স্থানীয় বেকারত্ব, শিক্ষা এবং মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির উপর সরকারী আক্রমণ -এগুলি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফসল এবং যা হাসিনা সরকার বা সম্ভাব্য ভবিষ্যতের বিএনপি শাসনের কাছে আবেদনের করার মধ্য দিয়ে সমাধান করা যাবে না।

এই আক্রমণগুলি শুধুমাত্র ছাত্রদের দ্বারা পরাজিত হতে পারে যখন তারা শ্রমিক শ্রেণীর দিকে ঘুরে দাঁড়াবে এবং তাদের সংগঠিত করার জন্য লড়াই করে, শাসক শ্রেণীর প্রতিটি উপদল এবং তাদের স্তালিনবাদী রাজনৈতিক সমর্থকদের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, একটি আন্তর্জাতিক এবং সমাজতান্ত্রিক পরিপ্রেক্ষিতের জন্য যা পুঁজিবাদের অবসান ঘটাবে এবং উৎপাদন ও সমাজকে পুনর্গঠিত করবে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী, ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য নয়।

Loading