Google, Facebook, Twitter এবং অন্যান্য শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সাহায্যে মার্কিন সরকার সমাজতান্ত্রিক, যুদ্ধবিরোধী ও প্রগতিশীল ওয়েবসাইটগুলির ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর প্রবল নিয়ন্ত্রণ চাপাচ্ছে। ইউরোপ এবং সারা বিশ্বের পুঁজিবাদী সরকারগুলিও একই রকম দমন নীতির আশ্রয় নিচ্ছে।
সেন্সরশিপ বা বিবাচনের এই নতুন রাজত্বে ইন্টারনেটে মানুষ কি পড়ছে, লিখছে এবং ভাবছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে প্রবলভাবে। রাষ্ট্র, সামরিক বাহিনী-গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এবং অভিজাত প্রযুক্তি সংস্থাগুলির এই জোটের কাজকর্ম মানুষের বাক্স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রধান গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য ভীষণ বিপদ নিয়ে এসেছে। "মিথ্যা সংবাদ" ও "রাশিয়ার হস্তক্ষেপ" নির্মূল করার নামে প্রতারণাপূর্ণ আড়াল নিয়ে একবিংশ শতাব্দী পুলিশ রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত মাঁচা খাড়া করা হচ্ছে।
২০১৭-র গ্রীষ্মে, ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট কিছু তথ্য প্রকাশ করে যা গুগ্ল্ কিভাবে অনুসন্ধানের ফলাফলকে অন্যায় ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এপ্রিল থেকে বামপন্থী ওয়েবসাইটগুলির পাঠক সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। ডাব্লু-এস-ডাব্লু-এস জানায় যে গুগ্ল-এর অনুসন্ধান থেকে বামপন্থী ওয়েবসাইটগুলিতে পাঠক আসা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে। এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত গুগ্ল্-এর অনুসন্ধানে যে ১৫০ শব্দবন্ধ ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইটে পাঠক টানায় শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিল, তাদের মধ্যে ১৪৫টি আমাদের ওয়েবসাইটের জন্য আর একটি পাঠকও আনে না।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইটের এই তদন্ত এও প্রকাশ করল যে অন্যান্য বিরোধী ওয়েবসাইট, যেমন globalresearch.ca, consortiumnews.com, counterpunch.org, alternet.com wikileaks.com এবং truthdig.org-এরও গুগ্ল্-এর মাধ্যমে পাওয়া পাঠক সংখ্যা বিপুল ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গুগ্ল্-এর প্রধান কার্য্যনির্বাহী সদস্যদের উদ্দেশ্য করে ২৫শে আগস্ট, ২০১৭-তে লেখা এক খোলা চিঠিতে ডাব্লু-এস-ডাব্লু-এস আন্তর্জাতিক সম্পাদক সমিতির প্রধান ডেভিড নর্থ লেখেনঃ
এতটা বিবাচন (censorship)রাজনৈতিক ব্ল্যাকলিস্টিং-এর সামিল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে গুগ্ল্-এর সেন্সরশিপ অ্যালগোরিদম্-এর অভিপ্রায় হলো যে খবরগুলো মানুষের কাছে পৌঁছক আপনাদের সংস্থা চায়না, সেই সংবাদগুলিকে আটকে দেওয়া এবং যে মতামতের সঙ্গে আপনাদের মত মেলে না, সেই মতামতগুলিকে দমন করা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গুগ্ল্-এর যা অধিকার, তার মধ্যে রাজনৈতিক ব্ল্যাকলিস্টিং-এর কোনো আইনসম্মত স্থান নেই। এটি একচেটিয়া ক্ষমতার অন্যায় অপব্যবহার। আপনারা যা করছেন, তা বাক্স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ।
আমরা তাই আপনাদের এবং গুগ্ল্-কে আহ্বান জানাচ্ছি ডাব্লু-এস-ডাব্লু-এস-(www.wsws.org) কে ব্ল্যাকলিস্ট করা বন্ধ করুন। আপনারা সব বামপন্থী, সমাজতান্ত্রিক, যুদ্ধবিরোধী এবং প্রগতিশীল ওয়েবসাইটগুলির ওপর যে সেন্সরশিপ চালাচ্ছেন, যে কারণে এই ওয়েবসাইটগুলো আপনাদের পক্ষপাতদুষ্ট অনুসন্ধান নীতির জন্য প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সম্মুখিন হচ্ছে, তা বর্জন করুন।
গুগ্ল্ এই চিঠির জবাব দেয়নি। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইম্স্-এ সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭-তে প্রকাশিত যে নিবন্ধে ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট-এর সন্ধানের এই ফলগুলির কথা বলা হয়, সেখানেই গুগ্ল্-এর বক্তব্য ছাপা হয়। গুগ্ল্ দাবি করেছে যে তাদের "অনুসন্ধানের এল্গোরিদ্ম্ প্রবল পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যায়, যাতে তার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক, লিঙ্গগত, জাতিগত বা উৎপত্তিগত পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ না পায়।"
এটি সর্বৈব মিথ্যা ছিল। ডাব্লু-এস-ডাব্লু-এস প্রথম প্রকাশ করার পর থেকে সরকার-সামরিক বাহিনী-গোয়েন্দা বিভাগ-কর্পোরেট প্রযুক্তির কমপ্লেক্স একদমই গোপন করছে না যে তারা বিশ্বব্যাপী ভাবে সেন্সরশিপের প্রচেষ্টা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি করছে। ডিসেম্বর ২০১৭-তে ট্রাম্প প্রশাসন নেট নিউট্রালিটি বা ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতা বাতিল করে। জার্মানি, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশের সরকারও ইন্টারনেটে বাক্ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান শুরু করেছে। জানুয়ারি ২০১৮-তে ফেসবুক তার নিউসফিডে কিছু বদল নিয়ে আসে, যার লক্ষ্য হলো প্রধানত বামপন্থী ওয়েবসাইটগুলির থেকে সংবাদ আটকে দেওয়া। এক বিশ্বাসঘাতকতামূলক বক্তব্যে ফেসবুকের প্রধান কার্য্যনির্বাহী আধিকারিক মার্ক জুকারবার্গ জানায় যে এই বদল করা হয়েছে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের "আরও বেশী সংযুক্ত করতে এবং একাকিত্ব কমাতে।"
গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর যে হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে তার প্রভাব সুদূরবর্তী এবং অবিলম্বে দেখা যাবে। ১৯৯০-এর দশকে ইন্টারনেট তৈরী হবার পর তা তথ্য বিনিময় ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের জন্য এক প্রশস্ত ক্ষেত্রের সৃষ্টি করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসাম্য, জনগণের মধ্যে বেড়ে চলা অসন্তোষ এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া আন্তর্জাতিক উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেরা এবং কোটিপতি গোষ্ঠীরা তথ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং যোগাযোগের প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে, তারা ইন্টারনেটকে রাষ্ট্রের নজরদারির, একনায়কতন্ত্রের, ব্যক্তিগত লাভের এবং যুদ্ধ তৈরীর যন্ত্র হিসাবে রূপান্তরিত করতে চাইছে।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট-এর জানুয়ারি ১৬-র "ইন্টারনেট সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আয়োজন" শীর্ষক ওয়েবিনারে উইকিলিক্স্ প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ সঠিকভাবে সাবধান করেছেনঃ
মানুষ কিভাবে নিজেদের ও অন্যান্য মানুষকে শিক্ষিত করার ক্ষমতার বিষয়ে ইন্টারনেট প্রায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এর ফলে যে গণতান্ত্রিক ব্যাপার ঘটেছে, তা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। গুগ্ল্, ফেসবুক এবং তাদেরই মতন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ যেগুলি চীনদেশে অবস্থিত, যারা বিদ্যমান অভিজাত শ্রেনীর সঙ্গে সামাজিক, যৌক্তিক ও অর্থনৈতিক ভাবে জড়িত, তারা বাক্স্বাধীনতার ওপর পুণরায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে।
ডাব্লু-এস্-ডাব্লু-এস্ ওয়েবিনারে অন্য একটি বার্তায় সমাজের সক্রিয় কর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জন পিলগার অনুসন্ধানের ফল এবং এলগোরিদমকে নিজেদের কাজে লাগানোর এই চক্রান্তকে "র্যা ঙ্ক বিবাচন" হিসাবে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন যে "স্বাধীন সাংবাদিকদের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলি থেকে বের করে দেবার ফলে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের সামনে আনার জন্য এবং আসল সাংবাদিকতা, অর্থাৎ প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণের জন্য ইন্টারনেট অত্যন্ত জরুরি উৎস হয়ে উঠছে।"
তথ্য কুক্ষিগত করে রাখার ক্ষেত্রে, প্রচারণার মাধ্যমে যুদ্ধ লাগানোয় তাদের সক্ষমতায় এবং একক ভাবে সম্পদ সংগ্রহ করে রাখা ও প্রবল সামাজিক অসাম্যকে বৈধ করে তোলার পথে শাসক শ্রেণী ইন্টারনেটকে এক অনতিক্রম্য বাধা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্র ও তথ্যের স্বাধীন প্রবহণ আধুনিক পুঁজিবাদের সঙ্গে বেমানান। বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক, অর্থাৎ ৩.৬ বিলিয়ন দরিদ্র মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে, প্রথম আট ধনকুবেরের কাছেও সমপরিমাণ সম্পদ আছে। সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে যে শাসক শ্রেণী, তারা পুঁজিবাদী শোষণের এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে আলোচনা, তথ্য আদানপ্রদান, এবং বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার মঞ্চ হিসাবে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে ভয় পাচ্ছে।
২০১৭ সালে সারা বিশ্বে ৩.৮ বিলিয়ন মানুষ, অর্থাৎ বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ মানুষ, ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। ২০০৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ বিলিয়ন, অর্থাৎ বিশ্বের জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ। এখন ইন্টারনেটে উপস্থিত ৭০ শতাংশের বেশী যুবক যুবতী, সব মিলিয়ে ৮৩০ মিলিয়ন মানুষ, যার মধ্যে কেবলমাত্র চীনের ও ভারতেরই ৩২০ মিলিয়ন। মোবাইল ব্রডব্যান্ডের সদস্য সংখ্যা ২০১২-তে ছিল ১.৭ বিলিয়ন এবং ২০১৭-তে তা ৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই বৃদ্ধির বেশীর ভাগটাই হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকায়। বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী এখন আগের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশী, অনেক বেশী সংযুক্ত এবং আন্তর্জাতিক ভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশী সংহত। তাই এখন তাদের রাজনৈতিক শক্তিও প্রবল।
ইন্টারনেট বিবাচন, তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও পুলিশ-রাষ্ট্রের নজরদারিকে ন্যায্য প্রমাণ করতে ডেমোক্রাটিক ও রিপাবলিকান রাজনৈতিক দলগুলি এবং কর্পোরেট মিডিয়া যে যুক্তিগুলি ব্যবহার করছে তা মিথ্যা ছাড়া কিছুই না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো গণতান্ত্রিক অধিকার ও বৈধ আইনি প্রক্রিয়া অপসারিত করতে এক প্রবল ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য ও এফ্-বি-আই-এর প্রতিনিধি ক্লিন্ট ওয়াট্স্ মার্কিন সেনেটকে ১৭ই জানুয়ারি জানান যে "বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অল্প-শিক্ষিত জনগণ যারা সাইবার জগতে আসছে প্রধানত মোবাইল ফোনের সাহায্যে, তারা সহজেই সন্ত্রাসবাদী ও স্বৈরাচারীদের দ্বারা সোশ্যাল মিডিয়ায় করা কুচক্রান্তের শিকার হবে।"
ওরওয়েলীয় ভাষায় ফেসবুকের উকিল মনিকা বিকার্ট সেনেটকে জানায়, "আমরা মিথ্যা খবরের প্রচার বন্ধ করে মানুষকে সঠিক খবর পৌঁছে দেবার জন্য নতুন নতুন রাস্তা বের করছি। আমরা জানি, মানুষও তাই চায়।"
'মিথ্যা সংবাদ'-এর আবাহন 'রাশিয়ার হস্তক্ষেপ'-এর চেয়ে কোনো অংশে কম মিথ্যা নয়। ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স্ ও ওয়াশিংটন পোস্টের (যা অ্যামাজনের জেফ বেজোস্-এর সম্পত্তি) কর্পোরেট মিডিয়ার পক্ষপাতী প্রচারকারীরা বিরোধী ওয়েবসাইটদের মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করে। অথচ, এই মিথ্যা খবর ছড়ানো আসলে এই পুঁজিবাদী প্রকাশনা সংস্থাদেরই বৈশিষ্ট।
এর জন্য "সব কিছু ধ্বংস করার অস্ত্র"- এর মিথ্যা দাবির চেয়ে ভালো উদাহরণ বোধহয় আর নেই। ২০০৩-এ ইরাক আক্রমণ করার আগে মার্কিন প্রশাসন এই দাবি করেছিল। এই আক্রমণে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যে সরকার সব সময় যুদ্ধ করে চলেছে, প্রত্যেক মহাদেশে নির্বাচিত সরকারকে বদল করার অপারেশন চালিয়েছে, এবং সারা বিশ্বে যাদের সৈন্যবাহিনী রাখা রয়েছে, তারাই "রাশিয়ার হস্তক্ষেপ"-এর সম্পূর্ণ অপ্রমাণিত দাবি করছে। বিরোধীতাকে অপরাধ রূপে দেখাতে এবং সমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ করাকে বিশ্বাসঘাতকতার সমতূল্য করে তুলতে শাসক শ্রেণী এই সব সাজানো অভিযোগ ব্যবহার করছে।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সঙ্গে সব সময়ই এক সঙ্গে থাকে রাজনৈতিক দমননীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবার কয়েক সপ্তাহ পরে কংগ্রেসে এস্পায়োনেজ অ্যাক্ট বা গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত আইন পাশ হয়, যার জোরে সমস্ত সমাজতন্ত্রীদের জেলে পোড়া হয় এবং চরমপন্থী প্রবাসীদের বিতাড়িত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকার সমাজতন্ত্রীদের আটকেছিল তাদের সংবাদপত্র বিলি করা থেকে, ট্রটস্কিপন্থীদের স্মিথ আইন দ্বারা অভিযুক্ত করেছিল এবং ১০০,০০০-এর ওপর জাপানীদের বন্দী শিবিরে পাঠিয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় জনবিরোধের সম্মুখীন হয়ে জনসন ও নিক্সন প্রশাসন নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কর্মীদের এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে কুখ্যাত কোয়েন্টেলপ্রো ব্যবস্থা চালু করে। ২০০১ সাল থেকে প্যাট্রিয়ট ও ফিসা আইনের মাধ্যমে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা জনগণের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। তারা কালা সাইটের জেলের আন্তর্জাল বানাচ্ছে এবং 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই'-এর নাম করে সি-আই-এ-তে কর্মরত অত্যাচারীদের রক্ষা করছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার গণতান্ত্রিক শক্তিকে মার্কিন মিলিটারি তাদের কার্য্যক্রমের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান বাধা হিসাবে দেখে। ২১শে ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখের এক কৌশলগত দলিলে মার্কিন আর্মি ওয়ার কলেজ লেখেঃ "একটি ডিজিটাল শহরে সোশ্যাল মিডিয়া ও তথ্যের (এবং ভুল তথ্যের) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বিরাট প্রভাব থাকতে পারে... এখানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, পুলিশের হাতে মানুষ মারা যাচ্ছে, এমন ভিডিও যখন প্রকাশ করা হয়েছে, তখন তা বহু প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।"
এপ্রিল ২০১৭-তে প্রকাশিত অন্য একটি দলিলে ওয়ার কলেজ তাদের ভীতি প্রকাশ করেছে যে "যেখানে জনগণের কাছে স্মার্টফোন আছে এবং তারা তাদের অঞ্চলে যে ঘটনা ঘটছে তা সম্বন্ধে যখন অন্যদের জানাতে আগ্রহী, তখন তারা সমগ্র জনগণের কাছে তাৎক্ষণিক ঘটনার ছবি তুলে ধরতে সক্ষম হয়"।
এই বিপদের সম্ভাবনাকে ছোটো করে দেখা উচিত নয়। স্বাধীন সাংবাদিক ক্রিস হেজ, যিনি ডেভিড নর্থের সঙ্গে ডাব্লু-এস-ডাব্লু-এস-এর ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর ভাষায় বলা যায়ঃ
এই বিবাচন বিশ্বব্যাপী। জার্মান সরকারের নেটওয়ার্ক এন্ফোর্সমেন্ট আইন তথাকথিত আপত্তিকর বিষয় থাকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির ওপর জরিমানা ধার্য্য করে। ফরাসী রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাকরণ ইন্টারনেট থেকে 'নকল সংবাদ' নির্মূল করার ব্রত নিয়েছেন। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম চেচান রিপাবলিকের একনায়ক রামজান কাদিরভের অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলেছে, কারণ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তালিকাতে তার নাম আছে। কাদিরভ নিঃসন্দেহে ঘৃণ্য, কিন্তু মার্কিন সিভিল লিবার্টিস্ ইউনিয়ন-এর মত অনুযায়ী, এই নিষেধাজ্ঞা মার্কিন সরকারকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিচ্ছে কার্য্যকর ভাবে বিষয়বস্তুকে বিবাচন করবার। ইজরায়েল সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করে ফেসবুক প্যালেস্তানীয় সক্রিয় কর্মীদের ১০০-র বেশী অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলেছে। এই ভাবে আমরা এক ভয়াবহ ওরওয়েলীয় বিশ্বের দিকে এগিয়ে চলেছি যেখানে বিরোধী চিন্তা আটকানোর ভাবনা-পুলিশ বর্তমান, নিউস্পিক ও ভাবনা-অপরাধ হয়, বা, ফেসবুকের ভাষায়, "র্যা ঙ্ক মুছে ফেলা" এবং "প্রতিবাদী বক্তব্য" রয়েছে। [Truthdig.com, জানুয়ারি ২১, ২০১৮]
গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্রমবর্দ্ধমান বিপদগুলির প্রতিরোধ করতে হবে। এর জন্য ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ও নজরদারির বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর জোটের সংগঠন ও সমন্বয় প্রয়োজন। শেষের দিকে, ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট সমাজতান্ত্রিক, যুদ্ধবিরোধী এবং প্রগতিশীল ওয়েবসাইটগুলির আন্তর্জাতিক জোট গঠন করার কাজে অর্থ জোগান দিয়েছে। যে সকল সমাজতন্ত্রী, যুদ্ধবিরোধী এবং প্রগতিশীল ওয়েবসাইট ও সংস্থা এবং একক কর্মী ও সাংবাদিকরা ইন্টারনেট সেন্সরশিপ বিরোধী জোট তৈরী করতে ইচ্ছুক ও প্রস্তুত, তাদের আমরা স্বাগত জানাই।
কিন্তু সমাজতন্ত্রী, যুদ্ধবিরোধী ও প্রগতিশীল ওয়েবসাইটদের আন্তর্জাতিক জোটকে কার্য্যকর করতে হলে কিছু নীতির বিষয়ে মতৈক্য প্রয়োজন, যাদের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিও থাকা উচিৎঃ
- ইন্টারনেট একটি অধিকার যা সবার কাছে সমান ভাবে বিনামূল্যে লব্ধ হওয়া উচিত। ইন্টারনেটকে রাজনৈতিক দলগুলির জন্য এবং বিনামূল্যে তথ্য, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন মতামত আদানপ্রদান করার মঞ্চ হিসাবে রক্ষা করতে হবে।
- সরকার ও ব্যক্তিগত মালিকানার কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ থেকে ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আপোষহীন সংগ্রাম।
- নেট নিউট্রালিটি (ইন্টারনেট নিরপেক্ষতা) এবং বিনামূল্যে সবার কাছে সমান ও বাধাহীন ভাবে ইন্টারনেট পৌঁছে দেবার বিষয়টিকে আপোষহীন ভাবে সমর্থন করতে হবে।
- মানব মূল্যায়নকারির ব্যবহার, যা ওয়েবসাইটগুলিতে সাধারণের অধিকার সীমিত ও বন্ধ করে দেয়, এবং সরকার ও কর্পোরেট সংস্থাদের দ্বারা ইন্টারনেট সার্চের গাণিতিক পরিভাষা ও পদ্ধতির অপব্যবহারকে অবৈধ বলে ঘোষণা করতে হবে এবং তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।
- ইন্টারনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টিকারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওয়েব বা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি করার আপোষহীন বিরোধীতা করতে হবে।
- জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ ও এডওয়ার্ড স্নোডেনের ওপর থেকে সব রকম নিষেধ উঠে গিয়ে তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবার দাবি করতে হবে।
- ইন্টারনেটের ওপর কর্পোরেটদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে আন্তর্জাতিক সমন্বিত গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত মুনাফায় জোর না দিয়ে সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করতে হবে।
- পুঁজিবাদী সরকারদের এবং তাদের ধামাধারী দল ও রাজনীতিকদের কাছে আবেদন করে কখনোই ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নেমে আসা বাধার বিরুদ্ধে লড়াই এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার সংগ্রামকে সফল করা যাবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর একমাত্র উপায় এদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করা। এছাড়াও, এই সংগ্রামের প্রশস্ততা আন্তর্জাতিক এবং এটি সম্পূর্ণভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী সামরিকীকরণের বিরোধী। তাই যাঁরা সত্যিই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কাজে ব্রতী, তাঁরা সব দেশে শ্রমিক শ্রেণীকে সঙ্গবদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারেন।
এই নীতি অনুযায়ী, এই আন্তর্জাতিক জোট জরুরি ভিত্তিতে নিম্নলিখিত কাজগুলি করা প্রয়োজনঃ
- নিয়ম মেনে এক অভিযান শুরু করা যার মাধ্যমে কিছু লেখা তৈরী করা যা ইন্টারনেটে দেওয়া হবে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে যাকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এই লেখাগুলিতে সরকারী এবং কর্পোরেট নিষেধাজ্ঞার বিরোধীতা করা হবে এবং এগুলিকে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা মাধ্যম, মুদ্রিত লিফলেট, ব্রোশার ও প্যামফ্লেটের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
- প্রবন্ধ, ভিডিও, সাক্ষাৎকার, ছবি ও অন্যান্য বিষয় দিয়ে একে অপরকে সাহায্য করে ইন্টারনেটে বাক্স্বাধীনতার ওপর যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে তা সম্বন্ধে মানুষকে আরও সচেতন করে তোলা।
- কাজের স্থানে, পাড়ায়, এবং স্কুলে ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সভার আয়োজন করা এবং আলোচনার দল তৈরী করা।
- মিলিত শক্তিকে একত্রিত করে ওয়েবসাইট, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা, যাদের সেন্সর ও রাষ্ট্র নিশানা বানায়, তাদের রক্ষা করা এবং তাদের কথা প্রচার করা।
সরকার এবং কর্পোরেশনরা ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্র করছে, তার বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শানানো শুরু করতে জোটের নীতি ও কাজের বিষয়ে মতের ঐক্য থাকলে শুরুটা কার্যকর হবে।
সমাজতান্ত্রিক, যুদ্ধবিরোধী ও প্রগতিশীল ওয়েবসাইটদের আন্তর্জাতিক জোটে বহু রাজনৈতিক প্রশ্নে নানান ধরণের মতামত এবং বিরোধীতামূলক দৃষ্টিভঙ্গী থাকাটা অবশ্যম্ভাবী। এই জোটে অংশগ্রহণ করা মানেই একই রাজনৈতিক মতাদর্শ মেনে চলতে হবে, এমন কোনো মানে নেই। অংশগ্রহণকারী ওয়েবসাইট ও সংস্থাগুলি তাদের কাজ স্বাধীন ভাবে চালিয়ে যেতে পারে।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট অন্যান্য সংস্থাকে বলে দিতে চায় না তাদের রাজনীতি কি হবে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত একতার স্বার্থে যদি আমাদের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বাধা দেওয়া হয়, তাও মেনে নেওয়া হবে না।
চতুর্থ ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক কমিটির ইন্টারনেটের প্রতিনিধি হিসাবে ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট তার মার্ক্সীয় ও সমাজতান্ত্রিক কার্য্যক্রম, নীতি ও বিশ্লেষণকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা প্রযুক্তির ওপর একাধিপত্যের বিরুদ্ধে এবং ইন্টারনেটের আন্তর্জাতিক ও গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব মানুষকে বোঝাতে যে বাক্ স্বাধীনতা এবং সকল গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে গেলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রয়োজন, আর দরকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট মনে করে শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থারা ইন্টারনেটের ব্যবহারের ওপর যে অন্যায় নিয়ন্ত্রণ চাপাচ্ছে, কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীকে এই লড়াইয়ের অন্তর্ভূক্ত করেই তার সফল বিরোধীতা করা সম্ভব। শ্রমিক শ্রেণী এই বিষয় বোঝানো অত্যন্ত জরুরি যে তাদের জীবনযাত্রার মান, কর্মস্থানের পরিবেশ, মাইনে ইত্যাদি নিয়ে তাদের শ্রেণী স্বার্থের জন্য যে লড়াই তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ রয়েছে। বিকল্প সংবাদের উৎস ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের অধিকার না থাকলে বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা তাদের অভিন্ন সংগ্রামগুলিকে সঙ্গবদ্ধ করতে পারবে না। ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের অধিকার শ্রমিক শ্রেণীকে সাহায্য করবে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও সাম্যের লক্ষ্যে তাদের যে লড়াই তাকে আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে। ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট নিশ্চিত যে ইন্টারনেটের অন্যায় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, যা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তাকে শ্রমিক শ্রেণী স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমর্থন করবে। এই সংগ্রাম তাদেরই লড়াই। এমন ভাবাটা অন্যায় যে বাক্স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই তাতে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ করাটা অত্যন্ত জরুরি। বরং বলা ভালো, বাক্স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই শ্রমিক শ্রেণীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। জোট বাঁধার কাজ করাকালীন ও আলোচনার সময়ে আমরা এই কর্মসূচিতে এবং ইন্টারনেটের সরকারি ও কর্পোরেট দ্বারা ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ এবং সেন্সরের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লড়াইয়ের প্রতি অন্যদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করব।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েবসাইট সকল সমাজতান্ত্রিক, যুদ্ধবিরোধী এবং প্রগতিশীল ওয়েবসাইট, সংস্থা, দল এবং কর্মীদের আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক, যুদ্ধবিরোধী ও প্রগতিশীল ওয়েবসাইটদের জোট বাঁধার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে ও যারা এগিয়ে আসছে, তাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
এই জোটে যে সকল ওয়েবসাইট বা সংস্থা যোগ দিতে ইচ্ছুক, তাদের প্রতিনিধিরা endcensorship@wsws.org-এ ইমেলের মাধ্যমে তাদের জিজ্ঞাস্য বিষয় পাঠাতে পারেন। যে সকল ব্যাক্তি এই জোট বাঁধার কাজে অংশগ্রহণ করতে চান, তাঁরা এই ফর্মটি জমা দেবেন।